সাইবার-অপরাধের বিরুদ্ধে সারা দেশে নজির গড়ল রানাঘাট পুলিশ জেলা। কীভাবে? শুরু থেকে শুরু করা যাক। ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’, অতঃপর সেই অ্যারেস্ট-এর হাত থেকে বাঁচতে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়, এবং তারপর পুলিশে অভিযোগ। গত বছরের ৬ নভেম্বর। রানাঘাট পুলিশ জেলার অন্তর্গত কল্যাণী সাইবার থানায় জমা পড়ে অভিযোগ। প্রতারিত ব্যক্তি জানান, মুম্বই পুলিশের এক আধিকারিকের পরিচয় দিয়ে তাঁকে ডিজিটাল অ্যারেস্ট করে এক জালিয়াত, এবং রেহাই পাওয়ার আশায় সেই ‘পুলিশ অফিসারের’ নির্দেশমতো ১ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করে দেন তিনি।
এই পর্যন্ত ঘটনাবলী চেনা পথেই এগোচ্ছে, তাই তো? আপনারা প্রায় সকলেই জানেন, ডিজিটাল অ্যারেস্ট বলে কিছু হয় না। কিন্তু বহুল প্রচার সত্ত্বেও এই প্রতারণার ফাঁদে পড়েই চলেছেন অনেকেই। আরও অনেক মামলার মতোই এই মামলাটিও অনির্দিষ্টকাল চলতে পারত, শেষমেশ হয়তো জালিয়াতির টাকা উদ্ধারও হতো, কিন্তু শাস্তি হত না অপরাধীদের। কারণ সাইবার জগতে অপরাধীদের ‘ট্র্যাক’ করা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার চেয়েও দুরূহ।
কিন্তু এখানেই বদলে গেল ছবি। তদন্তকারী অফিসার সাব-ইন্সপেক্টর দেবারুণ দাস ও তাঁর টিম নামলেন ছক ভাঙার খেলায়। তদন্তে প্রকাশ পেল, যে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে ফোন এসেছিল প্রতারিতের কাছে, তার অবস্থান দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কাম্বোডিয়ায়। অথচ সিম কার্ড জারি করেছে একটি ভারতীয় মোবাইল পরিষেবা সংস্থা, এবং কাম্বোডিয়ায় বসেও পরিষ্কার বাংলা ও হিন্দিতে কথা বলছে ফোনের মালিক। শুধু তাই নয়, যেসব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করেন প্রতারিত, সেগুলির মালিকও সবাই ভারতীয়।
সেই শুরু। প্রযুক্তির সাহায্যে এরপর সামনে আসে আরও অসংখ্য তথ্য, এবং এক মাসের বেশি সময় ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে হানা দিয়ে অবশেষে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, গুজরাট এবং রাজস্থান থেকে দেবারুণ ও তাঁর টিম গ্রেফতার করেন মোট ন’জন অভিযুক্তকে। জানতে পারেন, এই ন’জনের নামে জাতীয় স্তরে জমা পড়েছে ১০০-র বেশি অভিযোগ, এবং এরা জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকেই এদের ‘রোজগার’ প্রায় ৬ কোটি!
তদন্ত চলাকালীন সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ প্রামাণ্য তথ্য গুছিয়ে চার্জশিট দাখিল করার পাহাড়প্রমাণ কাজটিও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। ফলে— ভারতে এই প্রথম ডিজিটাল অ্যারেস্ট সংক্রান্ত কোনও মামলা পৌঁছোয় আদালতে বিচারপর্ব পর্যন্ত। এবং এখানেই শেষ নয়, বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর শ্রী বিভাস চ্যাটার্জির তত্ত্বাবধানে মাত্র সাড়ে চার মাসে সম্পন্ন হয় বিচারপর্ব।
মামলার রায় বেরিয়েছে আজ। শাহিদ আলি শেখ, শাহরুখ রফিক শেখ, যতীন অনুপ লাডওয়াল, রোহিত সিং, রূপেশ যাদব, সাহিল সিং, পাঠান সুমাইয়া বানু, এবং অশোক ফালদু-কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।







